 
																
								
                                    
									
                                
পদ্মা সেতু সেই পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ৷ পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা বা অন্তরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা। পদ্মা সেতুর কারণে, যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে, তাই এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পর্যটন শিল্পকে তাদের ব্যবসায়িক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। এশিয়ার অন্যতম ‘টুরিস্ট প্যারাডাইজ’ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার বড় হাতছানি নিয়ে দাঁড়িয়ে এখন পদ্মা সেতু।
আমাদের দেশের পর্যটন শিল্প এখনো প্রকৃতি নির্ভর। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলে ভরপুর পর্যটনকেন্দ্রগুলো থেকে পরিকল্পনার অভাবে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার৷ বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেট আর রাঙামাটিকে পর্যটকেরা যেভাবে ‘ডেসটিনেশন গোল’ হিসেবে মনে করেন, সেভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানকে আমরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অভাবে এতোদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকৃষ্ট করতে পারিনি৷
ভারতের যেমন আছে পর্যটন সিটি ‘গোয়া’, আমরাও পারি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা পটুয়াখালিকে দক্ষিণের পর্যটন শহর বানাতে। এক পর্যটন খাত থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণের মানুষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য বদল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে পদ্মা সেতুর বদৌলতে৷ এজন্য দরকার, এ শিল্পের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি ও দুরদর্শী মহা-পরিকল্পনা। তাহলে দেশের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন ৩০ শতাংশে উন্নীত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান, এই তিন ‘প’ এর সমস্বয়ে স্থাপনা নির্ভর পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার কিংবা লন্ডনের থেমস নদীর স্থাপনা দেখতে যাওয়া একজন পর্যটকের মূল ‘ডেস্টিনেশন’ থাকে। আমাদের পদ্মা সেতুকেও সেই জায়গায় নিতে হবে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র আঁকছে পদ্মা সেতু। একে আরও ব্র্যান্ডিং করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। আসবে রপ্তানি বাণিজ্যের সুযোগও।
যে দেশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মতো বিশ্ব ঐতিহ্য আছে, নকশিকাঁথা আছে, যেদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে, যেদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আছে সেদেশে পর্যটন বিকাশ অবধারিত। দরকার ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি। যা ইতিমধ্যে হচ্ছে। আরও হবে।
শোনা যাচ্ছে, পদ্মাসেতু ‘ট্রান্স এশিয়ান এক্সপ্রেস হাইওয়ে রুটে’র সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এটি তখন ভারত, চীন, ইরান হয়ে ইউরোপের গন্তব্য হবে। ট্রেনে করে ইউরোপের যাত্রীরা নামবে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মাসেতু দেখতে। এটি হলে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের এক বিশাল গেইটওয়ে হতে যাচ্ছে পদ্মাসেতু ।
ভারি শিল্প, প্রবাসীদের রেমিটেন্স বা তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে এক কাতারে পর্যটন শিল্পকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির দুর্বার গতি দেখতে চাইলে এখনই এর একটি মেগাপ্লান দরকার।
ভৌতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরিও একটি ‘কি-ফ্যাক্টর’ বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর মধ্যে দেশের এক হাজার ১০০ স্পট নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার স্থাপত্য ও অবকাঠামোগত পরিবর্তনে বিনিয়োগ পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনার পর্যটন স্পটগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটে তাহলে পর্যটন শিল্পের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ সুপ্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বা দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফাকে পর্যটকরা দেখতে যেভাবে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে পদ্মা সেতুকেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং করে পর্যটক টানা সম্ভব।
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুধু পর্যটন সুবিধা বাড়িয়ে যেমন তার পর্যটনশিল্পকে অন্যতম প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির খাত হিসেবে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে গেছে, ঠিক তেমনি আমাদেরও সেই অবস্থানে আসার সময় এসেছে ৷ দরকার সঠিক সুপরিকল্পনা, বৃহদাকারে পর্যটন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়।
বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি যাতে বৈশ্বিক ও আভ্যস্তরীণ পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় কোন বৈশ্বিক মন্দা দেখা না দিলে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তেজিহারে বাড়তে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ভবিষ্যত বাংলাদেশকে পদ্মাসেতুর মতোই বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।