জাহিদুল ইসলাম বেলাল,,কুয়াকাটা প্রতিনিধি: পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রের সাথে লড়াই করে জেলেরা জীবন জীবিকা নির্বাহ করে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও তাদের অনেকেরই বসবাসের জায়গা নেই। নেই এক খন্ড জমি। যেখানে তারা স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করবে। মারা গেলে মাটি দেয়ার মত জায়গা টুকুও নেই। ঝড় বন্যা মাথায় নিয়ে সমুদ্রে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা
জায়গা কিংবা ঘরবাড়ি নেই এমন জেলেদের কথা চিন্তা করে সরকার ২০০৫ সালে খাপড়াভাঙ্গা নদীর কোল ঘেষে ৮০ পরিবারের জন্য গড়ে তোলেন একটি আশ্রয়ন প্রকল্প। যেখানে জেলেদের সুখে শান্তিতে বসবাস করার কথা। কিন্তু বসবাসের দুই বছরের মাথায় ভয়াল সিডর তাদের সেই সুখের নীড়ে হানা দেয়। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশ্রয়ন প্রকল্পটি। এরপর দীর্ঘ বছর চলে গেলেও মেরামত বা সংস্কার হয়নি আর। এরই মধ্যে নতুন করে দেখা দিয়েছে আরেক বিপদ। খাপড়াভাঙ্গা নদীটি জেলেদের প্রেতাশ্রয় হওয়ায় দ্রুত গতির ট্রলার চলাচলের কারণে নদীর পার ভেঙে যাচ্ছে। এতে আশ্রয়ন প্রকল্পটি ঝুঁকির মধ্যে পরেছে। কোন সময় আশ্রয়ন প্রকল্পটি নদী গর্ভে বিলীন হবার আশংকায় রাত দিন পার করছেন আশ্রয়ন প্রকল্পের প্রায় তিনশত বাসিন্দারা। নদী ভাঙ্গন রোধে এবং আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর গুলো সংস্থারের দাবি জানিয়ে আসলেও সারা দেয়নি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।
সরেজমিনে জানাগেছে,পটুয়াখালীর মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নের পশ্চিম খাজুরা গোড়া খাল আশ্রয়ন প্রকল্প। আন্ধারমানিক ও খাপড়াভাঙ্গা নদীর সংযোগ স্থলে নদীর কোল ঘেঁষে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আশ্রয়ন প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পটি গড়ে তোলার পর দীর্ঘ বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এ আশ্রয়ন প্রকল্পের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।
ঘরের টিনের চালায় মরিচা ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরছে। বেড়া নেই বেশিরভাগ ঘরে।
পলিথিন বিছিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে দিনযাপন করছে। আশ্রয়ন প্রকল্পটির অবস্থা এতই জরাজীর্ণ বসবাস অনুপযোগী। নেই কোন স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার। সুপেয় পানির ব্যবস্থা। নেই শিশু শিক্ষালয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করায় শিশু কিশোররা সব সময় পানি বাহিত রোগ সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন করে নদী ভাঙ্গনের কবলে পরে প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে ফেলেছে এখানকার বাসিন্দাদের।
ইতিমধ্যে এই আশ্রয়ন প্রকল্প ত্যাগ করে অন্যাত্র গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন ৯ টি পরিবার। যারা আছে তারাও এই আশ্রয়ন প্রকল্প ছেড়ে চলে যেতে চান। তবে তাদের অন্য কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় যেতে পারছে না।
এক গন্ড জমি, একটি ঘর পেয়ে জেলেরা খুশি হয়েছিল। তাদের সেই খুশি কয়েক বছর যেতে না যেতেই মলিন হতে শুরু করে।
আশ্রায়ন প্রকল্পে পাশ দিয়ে বয়ে যাওযা খাপড়াভাঙ্গা নদী দিয়ে দ্রুত গতির ট্রলার সহ নৌযান আসার যাওয়ায় নদীতে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে বড় বড় ঢেউ এসে আঁচড়ে পরছে আশ্রয়ন প্রকল্পে। জরাজীর্ণ ঘরে বসবাসরত জেলেদের যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। সব সময় আতংক নিয়ে বসবাস করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। এই বুজি ভেঙে নদীতে চলে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। সুখের নীড়ই জেলেদের এখন গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। অভাব অনটন নিয়ে বসবাসরত জেলেদের দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে যেখানে হিমসিম খেতে হচ্ছে, সেখানে ঘর মেরামত তো অনেক দুরের কথা। তাই ভাঙাচোরা ঘরেই বাধ্য হয়ে বসবাস করছেন তারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরে ধর্না দিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগী জেলেরা এমন অভিযোগ তাদের। তারা এ দেশের নাগরিক কিনা এমন প্রশ্ন এখানকার বাসিন্দাদের।
আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা জালাল হাওলাদার (৫৫) বলেন, আমরা যে ঘরে বসবাস করছি সেই ঘরে মানুষ তো দূরের কথা গরুর মহিষও থাকার উপযোগী নয়। গরু মহিষও এর চেয়ে ভালো জায়গায় রাখা হয়। জরাজীর্ণ এই আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা মিরাজ খলিফা,জালাল হাওলাদার (৫৫)
ছগির,জয়নাল,আবুল হোসেন,জামাল মোল্লা,
জালাল ফকির, সোহরাব সহ ৯ বাসিন্দা এখান থেকে চলে গেছে। আমাদের অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই তাই যেতে পারছি না, যাবার জায়গা থাকলে আমরাও চলে যেতাম। তার দাবী এই আশ্রয়ন প্রকল্পটি বিএনপি সরকারের সময় গড়ে তোলা হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকার তাদের এই ঘর মেরামত করে দেয় নাই।
আরেক বাসিন্দা নুর ইসলাম (৪০) বলেন, আমরা এখানে যারা বসবাস করছি সবাই জেলে। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এই আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাস করছি। প্রতিটি ঘরের টিন ক্ষয়ে পরছে। ঘরের দরজা জানালা, বেড়া নেই। ঘরে বসেই আমরা আকাশ দেখি। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরের ভিতরে পানি পরছে। কোন মতে পলিথিন ও তেরপাল দিয়ে বসবাস করছেন তারা। এ ঘরে কোন মানুষ থাকতে পারে না। বাধ্য হয়ে আমরা বসবাস করছি।
১ নম্বর সিরিয়ালের ১ নম্বর ঘরে বসবাস করেন আবুল কালাম হাওলাদার (৪৩)। কথা হয় তার সাথে। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর অনেক সাংবাদিক, এনজিও প্রতিনিধি, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তারা এসেছেন। তারা এসে শুধু আমাদের দূঃখ দুর্দশা দেখে শুনে গেছেন। বিভিন্ন জনে ঘর মেরামত সহ কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা বললেও কেউ কোন কথা রাখেনি। তার দাবী এই আশ্রয়ন প্রকল্প তাদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। সব সময় আতংক নিয়ে বসবাস করতে হয়। যে কোন সময় আশ্রয়ন প্রকল্পটি নদীর গর্ভে চলে যেতে পারে। আমারা এই পরিস্থিতিতে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
আশ্রয়ন প্রকল্পটির বাসিন্দারা এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি সভাপতি রুহুল আমিন মাঝি বলেন, আশ্রয়নের লোকজন বিষয়টি আমাদের অবহিত করার পর স্থানীয় ট্রলারগুলো আস্তে চালায়। কিন্তু দূর দূরান্তের ট্রলারগুলো দ্রুত চালাচ্ছে। যার কারণে আশ্রায়ন এলাকার ভাঙ্গন কমছে না।
এ বিষয়ে লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান হাওলাদার বলেন, বিষয়টি আমাকে আশ্রয়নের লোকজন অবহিত করেছে। আগামী দু’একদিনের মধ্যে আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে নদী ভাঙ্গন রোধ হবে। জরাজীর্ণ আশ্রয়ন প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা এবং পরিস্থিতি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ ইয়াসীন সাদেক বলেন, ‘বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানলাম। জরাজীর্ণ আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলো মেরামতের জন্য পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আলোচনা করব। নদী ভাঙ্গন রোধ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাথে বসে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।